আরাফাতের উত্তর দিতে না পারা প্রশ্নের উত্তর- ডিসফাংশানাল বাজারের বিকল্প গুলো - পর্ব ২
অনেকই অভিযোগ করেন, আমি শুধু সমস্যা দেখাই, বিকল্প দেখাই না। এই আলোচনায় আদানি প্রকল্প ও বাংলাদেশের কুইক রেন্টালের বিকল্প গুলো আলোচনা করেছি।
সালাম, জিয়া হাসান বলছি।
বিগত সাবস্টাকে Institute of Energy Economics and Financial Analysis এর টিম বাকলের সাথে আমার সাক্ষাতকারের রেফারেন্সে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, শুধু আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প নয়, কয়লা ভিত্তিক সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তিই এমন ভাবে দেশের স্বার্থ বিরোধী ভাবে করা হয়েছে যে, এই চুক্তি গুলোর দায় সম্পূর্ণ কমারশিয়াল জাস্টিফিকেশান বাদে নির্মাণ করা আদানির চুক্তির দায়ের সমান বা তারও বেশী পরেছে।
এই আলোচনাটির শেষে আমি দেখিয়েছি যে, ভারতে যেখানে বিদ্যুতের গড় দাম ৫ টাকা বা ৬ টাকা, সেখানে আরাফাত সাহেবেরা বাংলাদেশে ১৬ টাকা বা ২০ টাকায় বিদ্যুৎ কিনে চ্যালেঞ্জ করছেন এর চেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব না।
আমার আলোচনাটি মূলত আরাফাত সাহেবের এই ক্লেইমটি ঘিরেই- কেন বাংলাদেশে ১৫ টাকার নীচে বিদ্যুৎ কেনা সম্ভব নয়? আমাদের সীমাবদ্ধতা কোথায়? আমরা এক্সপ্লোর করতে চাই ভারত কীভাবে পারছে।
ভারতের বাজার থেকে দুই কি তিন গুণ দামে বিদ্যুৎ কেনার পেছনে ষ্ট্যাণ্ডার্ড ন্যারেটিভের সমস্যা
অনেক মানুষকে আমি পেয়েছি যারা বিদ্যুৎ খাতে জড়িত - ওয়েল মিনিং ভালো মানুষ- মনে করেন যে, বিদ্যুৎ খাতের প্রবলেমটা টেকনিক্যাল বা প্রাইমারি এনার্জি রিসোর্স (তেল, গ্যাস, কয়লা, রিনিউবেল ইত্যাদি) এর সীমাবদ্ধতার কারণে এসেছে।
যেটা তারা রিয়েলাইজ করেন না সেটা হচ্ছে, চ্যালেঞ্জটা আসলে টেকনিক্যাল। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রবলেমটা টেকনিক্যাল না- প্রবলেমটা পলিটিকাল, প্রবলেমটা দুর্নীতির। প্রবলেমটা সেই পলিটিকাল সেটেলমেন্টের, যে পলিটিকাল সেটেলমেন্টে শেখ হাসিনার সরকারকে কিছু এলিটদের ক্ষমতায়ন করে তাদেরকে ব্যাপক অর্থ যোগান দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করে ক্ষমতা টিকায় রাখতে হয়। যার কারনে , খুব উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই বাল্ক এনার্জি প্রকিউরমেন্টের মার্কেটটাকে সম্পূর্ণ প্রতিযোগিতাহীন ভাবে ডেভেলপ করে ডিসফাংশনাল বানিয়ে রাখা হয়েছে।
প্রাইমারি এনার্জির সোর্স যে বাংলাদেশ ডেভেলপ করতে পারে নাই, এর কারণও তাই। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট অংশে গ্যাস উৎপাদন করে মিয়ানমার চায়নায় বিক্রয় করতেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই ১২ বছর আগে সাগর জয়ের গর্বে গর্ভবতী হওয়ার পরে এক যুগে একটি গ্রহণযোগ্য সার্ভে পর্যন্ত করতে পারে নাই।
এইটার উদ্দেশ্যও এনার্জি প্রকিউরমেন্টের মার্কেটটাকে ডিসফাংসানাল বানায় রাখা। একটি সিলেক্টিভ গ্রুপকে অতিরিক্ত লাভ করিয়ে দিতে মার্কেট কে ডিসফাংশনাল করে রাখার কারণে প্রডাক্টের দাম ভারতের দ্বিগুণ তিন গুণ হয়ে গেছে।
মার্কেটের অনৈতিক প্লেয়ারদের ইন্সেন্টিভ দূর না করলে, টেকনিকাল সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়
এই মুহূর্তে চ্যালেঞ্জটা হলো, উত্তোলনযোগ্য প্রাইমারি এনার্জির পরিমাণটা নিশ্চিত না হওয়ার কারণে আপনাকে ডিসাইড করতে হবে কতটুকু অর্থ আপনি এক্সপ্লোরেশনে বিনিয়োগ করবেন, কতটুকু অর্থ দিয়ে আমদানি করবেন, এবং যে ক্যাপাসিটি টা আছে সেটার মধ্যে থেকে আপনি এনার্জি মিক্সটা কিভাবে নির্ধারণ করবেন। এসবের কস্ট বেনিফিট অ্যানালিসিস এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই এই মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ ।
কিন্তু প্রবলেমটা হলো আপনি যখন একটা কম্পিটিটিভ মার্কেট ডেভেলপ করতে দেবেন না, যখন নীতি নির্ধারক হিসেবে আপনার মূল গোলটাই হচ্ছে বাল্ক এনার্জি প্রকিউরমেন্টের মার্কেট টাকে ডিসফাংশনাল বানিয়ে রাখা যেন আপনি আপনার বাছাই করা প্রতিষ্ঠানদেরকে দিয়ে বিপিডিবির মনোপলি, সরকারের ভর্তুকি, পাবলিকের উপরে মাত্রাতিরিক্ত বিদ্যুতের বিলের দায় চাপিয়ে তিন গুণ দামে প্রোডাক্ট বিক্রি করতে পারেন। সেইখানে আপনি কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার টেকনিক্যাল সলিউশন বের করতে পারবেন না ।
কারণ, মার্কেট টাকে যেখানে কিছু এলিটদের ক্ষমতায়ন করার জন্য কমপ্লিটলি ডিসফাংশনাল বানিয়ে রাখা হইছে, সেই মার্কেটে আপনি যেই প্রোডাক্ট নিয়ে আসেন না কেন, ওই প্রোডাক্টের দাম দুই থেকে তিন গুণ হয়ে যাবে।
ভালো উদ্যোগগুলো নিয়ে আসলে ওইগুলোও বিভিন্নভাবে সাবোটাজড হয়ে যাবে।
রাইট আইডিয়াটাই মিডিয়া মার্কেট প্লেসে আসতেই দিবে না। মেইন সলিউশনটাকে তারা অনুল্লেখযোগ্য সলিউশন হিসেবে বা বিভিন্ন টেকনিক্যাল কারণ দেখায় বাতিল করে দিয়ে যে সলিউশনটা এই ডিসফাংশনাল বাজারে ক্রনিজদের জন্য সবচেয়ে লাভজনক হবে - সেই তিন গুণ মূল্যের সলিউশনটা সামনে নিয়ে আসবে এবং এমন ভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করবে, যেন প্রয়োজন থেকে তিন গুণ মূল্যের এই সলিউশন টা বাদে আর কোন বিকল্প নেই।
দেয়ার ইজ নো ওয়ে একটা ডিসফাংশনাল মার্কেটের মার্কেট প্রবলেম টাকে সলভ না করে, ডিসফাংশনাল মার্কেটের সোর্স পলিটিকাল প্রবলেম টাকে সমাধান না করে আপনি টেকনিক্যাল প্রবলেমটাকে স্বাভাবিক মার্কেটের কোনো পলিসি বা সলিউশন ব্যবহার করে সলভ করতে পারবেন।
কারণ আপনি যে টেকনিক্যাল সলিউশনই আনেন না কেন, এই সলুশনটা কাজ করবে না। সবচেয়ে ইনিফিশিয়েন্ট, সবচেয়ে করাপট, আর সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ সলিউশনটাই এই ডিসফাংশনাল বাজারে কাজ করবে।
বাংলাদেশের পলিটিক্যাল সেটেলমেন্টের সমাধান করা আমাদের গোল নয়, সেটা এই আলোচনার স্কোপের বহির্ভূত এবং এটার কোন সল্যুশন আছে কি-না আমার জানা নেই- ফলে আমি টেকনিক্যাল ইস্যুটাই আলোচনা করেছি। কিন্তু এই আলোচনায় ঢোকার পূর্বে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে প্রবলেমটা আসলে পলিটিকাল। এবং যারা মনে করেন যে এই পলিটিক্যাল প্রবলেমটা স্যাটেল না করে টেকনিক্যালি তারা প্রবলেম টা সলভ করতে পারবেন, তারা আল্টিমেটলি তিন গুণ মূল্যের সবচেয়ে এক্সপেন্সিভ খরচটাই মাঠে বজায় রাখবেন এবং তিন গুণ মূল্য পরিশোধ করার কারণে জনগণের বিদ্যুতের দামের বোঝা দাম বাড়বে, কস্ট অফ ডুইং বিজনেস বেড়ে যাবে, কর্মসংস্থান কমবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে না, এরকম যত ধরনের অর্থনৈতিক সমস্যা দেখতে পাচ্ছেন তার সবগুলোই ঘনীভূত হতে থাকবে।
কিন্তু আপনি এই ভেবে স্বস্তি পাবেন যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু তিন গুণ মূল্যের ব্যয়বহুল সরবরাহ ব্যবস্থাটি যে ধীরে ধীরে অর্থনীতি এবং আপনার সন্তানের ভবিষ্যৎ কে অল্প অল্প করে ধ্বংস করে নাজুক করে ফলছে, তা আপনার চোখে পড়বে না।
আজকের আলোচনার মূল পয়েন্টগুলো
ফলে, ভারত ও বাংলাদেশের বিদ্যুতের মূল্যের দুই থেকে তিন গুণ পার্থক্য তৈরি হওয়ার পেছনে বাংলাদেশের ডিসফাংসনাল বিদ্যুতের বাজারটিকে চেনার জন্যে আমরা জানবো-
১। ক্যাপাসিটি মার্কেট ছাড়াও বাল্ক বিদ্যুতের আর কী ধরনের বাজার বা কী ধরনের কন্ট্রাক্ট হতে পারে।
২।বিভিন্ন টাইপের বাজার ও কন্ট্রাক্টের মধ্যে ফ্ল্যাট রেট, লং ও শর্ট টার্ম মার্কেটের কন্ট্রাক্টের ধরণ নিয়ে আলোচনা।
৩। শর্ট টার্ম কন্ট্রাক্টের - ডে এহেড ও ইন্টারডে মার্কেট নিয়ে আলোচনা।
৪। এই বিভিন্ন ধরনের কন্ট্রাক্টের আলোচনা থেকে আমরা বোঝার চেষ্টা করবো আদানির বিকল্প হিসেবে ভারতের বাজারে বিপিডিবির আর কী কী ধরণের কন্ট্রাক্ট করার সুযোগ ছিল
৫। কেন এই সুযোগ গুলো প্রেক্ষাপটে আদানির সাথে বিপিডিবির কন্ট্রাক্ট একটা মোরনিক এক্টিভিটি হয়েছে, যা আমাদের জ্বালানী সিকিউরিটিকে পারমানেন্টলি খোঁড়া করে দিতে পারে।
৬। ভারতের মার্কেটে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সুযোগটি নিয়ে আলোচনা।
৭। ক্যাপাটালিজমের রিস্ক - রিওয়ার্ড রেশিওটিকে উলটে দিয়ে বাংলাদেশী ভোক্তাদের হাতে রিস্ক প্রিমিয়াম চাপিয়ে দিয়ে লীগের ক্রনিজদের অনৈতিক লাভের সুযোগ করে দেওয়া নিয়ে আলোচনা।
যথেষ্ট দীর্ঘ আলোচনা। পপকর্ণ নিয়ে বসেন।
শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, পুরো অর্থনীতিতেই প্রায় সকল প্রডাক্টের মূল্য ভারত থেকে ৩০% থেকে ৩ গুণ বেশী
মোহাম্মাদ এ আরাফাতের মূল যুক্তি, যে বাংলাদেশে কেউ ১৬ টাকায় বিদ্যুৎ বিক্রয় করতে পারবে না, এইটা শুধু বিদ্যুৎ খাত নয়, বাংলাদেশের পুরো অর্থনীতি নিয়েই আমার একটি অব্জারভেশান। অনেক গুলো প্রডাক্টে বাংলাদেশের মূল্য ভারত থেকে ৩০% থেকে তিন গুণ বেশী। আমার একজন বন্ধু বলে থাকেন, তিন গুণের এক ভাগ যায় আওয়ামী লীগ ও তার ক্রনিজদের কাছে, আরেক ভাগ আমলা, পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে, আরেক ভাগ যায় ব্যবসায়ীদের হাতে।
খুব মোটা দাগে বলা একটা কথা বলা হলেও এই বক্তব্যটির মধ্যে কিছুটা হলেও সার রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও বিভিন্ন কমপ্লেক্স ইস্যুর উপরে দাঁড়ায় থাকা এই সমস্যাটাকে খুব মোলায়েম ভাবে মার্কেট প্রবলেম হিসেবে চিহ্নিত করেন। আজকের আলোচনায় আমি এই মার্কেট প্রবলেমটিতেই ফোকাস করবো, কিন্তু সেই ফোকাসের পূর্বে আমরা একটু নিশ্চিত হয়ে নেই যে, ভারত থেকে বাংলাদেশের বাল্ক বিদ্যুতের ক্রয় মূল্য আসলেই দুই থেকে তিন গুণ বেশী।
বাংলাদেশ ও ভারতে বিদ্যুতের মূল্য তুলনা
আমরা চিত্র ১ এ দেখতে পাচ্ছি, ২০২১-২২ সালে বিপিডিবি বিদ্যুৎ ক্রয় করতে কোন উৎস থেকে কী পরিমাণ ব্যয় করেছে।
চিত্র ১। ২০২১-২২ এ বিপিডিবির বিদ্যুৎ ক্রয়ের পেছনে ব্যয়ের চিত্র।
আদানির চেয়ে ভারতের সরকারি বিদ্যুৎই বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী (bonikbarta.net)
চিত্র ১ এ আমরা দেখতে পেয়েছি, ২০২১-২২ এর ২০২১-২২ এ বিপিডিবির মোট খরচ হয়েছে ৭৪.২২ হাজার কোটি টাকা। যার মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা পরিমাণের বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে, যার গড় কিলোওয়াট ঘন্টা মূল্য পড়েছে ১১.৫৫ টাকা। যদিও মোট ক্রয়ের গড় ব্যয় ৮.৮৪ টাকা, কিন্তু আমার ফোকাস বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর রেটে, যার গড় ১১.৫৫ টাকা।
সম্পূর্ণ ভারতের লেভেলাইজড রেট আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। কিন্তু, ভারতের বিদ্যুতের কেনা-বেচার বাজার ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জের ডে এহেড মার্কেটের ২৩ এ মার্চের রেট টা দেখতে পারি। এই দিনে বাজারের ক্লিয়ারিং রেট ছিল ৩.৭৮ রুপি বা ৪.৯০ টাকা।
চিত্র ২। ইন্ডিয়ান এনার্জি এক্সচেঞ্জ মার্কেটে ডে এহেড মার্কেটে বিদ্যুতের ক্লিয়ারিং রেট
IEX | Indian Energy Exchange Limited | IEX India
বলে রাখা ভালো, ডে এহেড মার্কেটের রেট লং টার্ম কন্ট্রাক্ট থেকে বেশী। আইইএক্সে ডিসেম্বার ২০২২ এ ভারতের কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুতের গড় দাম ছিল ৫.২৩ রুপি বা ৬১.১৭ টাকা (IEEFA, February 2023)। ভারতের বাজারে অধিকাংশ দীর্ঘমেয়াদী কন্ট্রাক্টের মূল্য ৫ থেকে ৬ টাকা। রিনিউবলের মূল্য আরো কম।
২০২২ এ ভারতের বিদ্যুতের গড় মূল্য আমার চোখে পড়ে নি, কিন্তু, সেই রেটটি কোন মতেই ৪ থেকে ৫ রুপির বেশী ছিল না। ভারতের অধিকাংশ লং টার্ম কন্ট্রাক্ট ৫ থেকে ৬ টাকার মধ্যে।
বাল্ক বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্যাপাসিটি কন্ট্রাক্ট বাদেও অন্য ধরনের কন্ট্রাক্ট রয়েছে
এখন ভারত কিভাবে ৫ টাকা বিদ্যুৎ কেনে, এইটা বুঝতে হলে আমাদের বাল্ক বিদ্যুতের মার্কেটের টাইপ টা বুঝতে হবে ।
বাল্ক বিদ্যুতের তিন ধরনের মার্কেট থেকে তিন ধরনের কন্ট্রাক্ট হতে পারে।
১। ক্যাপাসিটি মার্কেট
২। ফ্লাট রেট শর্ট ও মিড টার্ম মার্কেট
৩। শর্ট টার্ম পে এজ ইউ গো মার্কেট, যার মধ্যে রয়েছে ডে এহেড মার্কেট, ইন্ট্রাডে মার্কেট ও ফ্রিকুয়েন্সি কন্ট্রোল মার্কেট।
ক্যাপাসিটি মার্কেট ইলেক্সট্রিসিটি প্রডিউসারদের ক্যাপাসিটি রিজার্ভ করা হয়, যার মাধ্যমে একজন বায়ার ইলেক্ট্রিসিটি প্রভাইডারকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যাপাসিটি রিজার্ভ করার জন্যে সুনির্দিষ্ট হারে পেমেন্ট করে। এই পেমেন্টে বিনিয়োগের ফিনান্স কস্ট, ক্যাপেক্স, অপেক্স ডেপ্রিসিয়েসন সব কিছুই হিসেব করা হয়। আদানির বিদ্যুৎ প্রকল্প ও স্থানীয় আইপিপি গুলোর সাথে চুক্তি মূলত ক্যাপাসিটি মার্কেট।
কোন ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ পেমেন্ট না করে - ফ্লাট রেট শর্ট ও মিড টার্ম মার্কেট থেকে বিদ্যুৎ কেনা যায়
অন্য দিকে, শর্ট, লং ও মিড টার্ম ফ্লাট রেট মার্কেটে কোন ধরনের ক্যাপাসিটি চার্জ পেমেন্ট করা হয়না, একটা ফ্লাট রেটে বিদ্যুৎ ক্রয় করা হয়।
২০১৩ সালে ভারতের পিটিসির সাথে বাংলাদেশের ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিটি ফ্লাট রেট শর্ট ও মিড টার্ম ফ্লাট রেট কন্ট্রাক্টের ভালো উদাহরণ। পিটিসির সাথে ২০১৩ ফ্লাট রেটে ৩ বছরের চুক্তি হয়েছিল, যে চুক্তিটি ২০১৬ সালে এক্সপায়ার করে। পরবর্তীতে কন্ট্রাক্টি ৬ মাস করে করে বৃদ্ধি করা হয়। এখানে পিটিসি তার নিজস্ব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, পিটিসিকে ক্যাপাসিটি চার্জ আলাদা করে দেওয়ার কিছু নেই। চুক্তিটি ফ্লাট রেটে।
বাংলাদেশের জন্যে ভারতের সাথে ফ্লাট রেটের চুক্তি অপেক্ষাকৃত লাভজনক
ভারতের রাষ্ট্রীয় সংস্থা, এনটিপিসির পাওয়ার ট্রেডিং আরম এনভিভিএন ২০১৮ তে বিপিডিবির সাথে ৩০০ মেগা ওয়াটের শর্ট টার্ম ও লং টার্ম চুক্তি করে । শর্ট টার্মের সময়কাল ছিল জুন ২০১৮ থেকে ডিসেম্বার ২০১৮। এবং দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি ছিল জানুয়ারি ২০২০ থেকে মে ২০৩৩।
কম্পিটিভ বিডিং এর চুক্তিতে এন্টিপিসি কন্ট্রাকটি জয় করে।
এনভিএনএনের সাথে বিপিডিবি ত্রিপুরা থেকে, ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ক্রয় করার চুক্তি করে, ২০২১ এ। এই চুক্তিতে ২০২১ থেকে ৬.২৭ রুপি ফিক্সড রেট ও বছরে বছরে ২% এসকেলেশান ধরে চুক্তি করা হয়।
চিত্র ৩। বিপিডিবি এনভিভিএন এর সাথে ৬.২৭ রুপি ও বাৎসরিক ২% বৃদ্ধির হার ধরে ফ্ল্যাট কন্ট্রাক্ট করেছে
বাংলাদেশের সাথে ভারতের এই ধরনের কয়টি চুক্তি রয়েছে, তার তথ্য আমি খুঁজে পাইনি। কিন্ত শেয়ারবিজের একটি রিপোর্ট থেকে ৫টি কেন্দ্রের তথ্য পেয়েছি যা নীচে দিলাম।
চিত্র ৪। ভারতের সাথে বাংলাদেশের পাঁচটি ফ্লাট রেট চুক্তি রয়েছে- যে চুক্তি গুলোতে বাংলাদেশ আদানির চুক্তি অপেক্ষা অনেক বেশী লাভবান হচ্ছে।
এই চুক্তি গুলো আমার হাতে নেই, কিন্তু, এই চুক্তি গুলোর সার্বিক ভাবে আদানির কন্ট্রাক্ট থেকে বেটার। কারণ, এই চুক্তি গুলোতে ক্যাপাসিটি চার্জ রয়েছে কি-না তা জানা নেই, কারণ বিপিডিবি চুক্তি গুলো প্রকাশ করে না। কিন্তু মিডিয়ার তথ্য থেকে যা দেখতে পেয়েছি, তাতে কোন কোন কন্ট্রাক্টের সময়কাল ৬ মাস, কোনটি ৩ বছর।
ফলে, চাহিদা অনুসারে এই বিদ্যুৎ গুলো বিপিডিবি কিনতে পেরেছে। ক্রিটিকাল বিষয় পারলেও আমি যে তথ্য গুলো খুঁজে পেয়েছি, তাতে চুক্তি গুলো ফ্লাট রেটে করা হয়েছে। এবং এর ফলে যেটা হয়েছে, তা হলো বাংলাদেশের সাবসিডাইজড গ্যাস ব্যবহার করে উৎপাদিত প্রকল্প গুলো বাদে ভারতের কাছ থেকে কেনা এই চুক্তি গুলো বাংলাদেশের জন্যে সব চেয়ে ভালো কন্ট্রাক্ট, যা আমরা পরবর্তী চিত্র থেকে দেখতে পাচ্ছি।
চিত্র ৫। সাবসিডাইজড দেশীয় গাস বাদে, ফ্লাট রেটে করা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের চুক্তি গুলো বিপিডিবির জন্যে সব চেয়ে সাশ্রয়ী
এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের কাছ থেকে ক্রয় করা বিদ্যুতের গড় দাম ৬.১১ টাকা। ইন্টেরেস্টিংলি, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর একটি বাদে সব গুলোই কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এবং এই কেন্দ্র গুলো ভারতের কয়লা ব্যবহার করছে। যেহেতু ভারতের আভ্যন্তরীণ কয়লার দাম আন্তজারতিক মূল্যের থেকে প্রায় ৩ ভাগের এক ভাগ, ফলে এই চুক্তি গুলো বাংলাদেশের জন্যে বিদ্যুৎ আমদানির সব চেয়ে সস্তা সূত্র।
এই জায়গাতেই , টিম বাকলে আদানির কন্ট্রাক্টের সমালোচনা করেছেন। তার যুক্তিটা ছিল, ভারত বিদ্যুৎ সারপ্লাস একটি দেশ। তাদের যে হারে রিনিউয়েবল সোর্স বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাই দীর্ঘ মেয়াদী উচ্চ মূল্যে বিদ্যুৎ কিনলে তোমরা ভারতের বিদ্যুতের মূল্য কমার সুযোগটা পাচ্ছো না।
এইখানে ক্রিটিকাল একটা ডাইনামিক্স হচ্ছে, এই কেন্দ্র গুলো ভারতের আভ্যন্তরীণ কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যে কয়লার দাম বিদেশ থেকে কয়লার তিন ভাগের এক ভাগ। কিন্তু, আদানির চুক্তিতে কয়লা আমদানি করতে হচ্ছে, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে কয়লার দাম বৃদ্ধি পাওয়াতেই মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, যেইটা আভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলোর ক্ষেত্রে হয় না। কারণ, তাদের খনি মুখ কেন্দ্র গুলোতে লং টার্ম ফ্লাট রেট চুক্তি আছে (অনেকের)। বাংলাদেশ চাইলেও মিডিয়াম টার্ম বা লং টার্ম ফ্লাট রেট চুক্তি করতে পারে, যাতে উভয় পক্ষের লাভ। কারণ তাতে উভয় পক্ষের অনিশ্চয়তা কমে।
এখানে আরো একটা ইন্টেরেস্টিং কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ডাইনামিক্স হচ্ছে ভারতের রিনিউবেল গুলো মূলত উত্তর ও উত্তর পশ্চিম ভারতে। কিন্তু, কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র গুলো মূলত পূর্ব ও মধ্য ভারতে। বাল্ক বিদ্যুতের ক্রয়-বিক্রয়ে দূরত্ব একটি বড় ফ্যাক্টর। ফলে পূর্ব ভারতের একাধিক প্রতিষ্ঠানের আগ্রহ আছে বাংলাদেশে বিদ্যুত বিক্রয়ের। কারণ তাদের স্থানীয় চাহিদা নেই। অধিকাংশ কয়লা ভিত্তিক কেন্দ্র গুলো আন্ডার ক্যাপাসিটি এবং ক্ষতির মুখে আছে।
ফলে, এমনকী, ভারতের রাষ্ট্রীয় এনটিপিসিও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রয়ে আগ্রহী। যেখানে ভারতের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ভারতীয় কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ বিক্রয়ের তারা সমালোচনা করেছে-যে সমালোচনা কমারশিয়াল কারণে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি।
চিত্র ৬। ভারতীয় প্রতিষ্ঠানেরা বাংলাদেশে ভারতীয় কয়লা ব্যবহার করে বিদ্যুৎ বিক্রয়ের সমালোচনা করেছে
ফলে আদানিকে নিয়ে প্রশ্ন এইটাই যে, বাংলাদেশ যেখানে ভারতীয় কয়লা দিয়ে, কম মূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয় করতে পারবে, সেখানে কেন আদানির কাছ থেকে দ্বিগুণ দামে, বিদেশ থেকে কয়লা এনে বিদ্যুৎ কিনবে? টিমের আরগুমেন্ট হচ্ছে, এইটার কোন কমারশিয়াল জাস্টিফিকেশান নাই। এই ধরনের চুক্তি শুধুমাত্র মোরনেরাই করতে পারে।
বাল্ক বিদ্যুতের শর্ট টার্ম মার্কেট
এই ফ্লাট শর্ট ও মিড টার্ম ফ্লাট রেট মার্কেট ও ক্যাপাসিটি মার্কেট বাদেও বিদ্যুতের আরেকটি মার্কেট রয়েছে, যে মার্কেট থেকে এক দিন পূর্বে, বা এমন কী ১৫ মিনিটি পূর্বে চাহিদা দিয়ে বিদ্যুৎ কেনা যায়।
ডে এহেড মার্কেট
ব্লক অফ এনার্জি কেনা যায়। এই মার্কেটে আপনি বলতে পারবেন যে, আমার আগামীকাল গ্যারেন্টেড একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মেগাওয়াট ঘন্টা বিদ্যুৎ লাগবে।
ইন্ট্রাডে মার্কেট।
ইন্ট্রা ডে মার্কেটে ডেলিভারির ১৫ মিনিট পূর্বে ইলেক্ট্রিস্টি ক্রয় করা যায়। ইন্ট্রা ডে মারকেটের প্রাইস, ডে এহেড মার্কেট থেকে বেশী হয়, কারণ আপনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে এনার্জি চাইতেছেন।
এই দুইটা মার্কেট বাদেও, গ্রিডের ফ্রিকুয়েন্সিতে ইকুইলিব্রিয়াম মেন্টেন করার জন্যে জন্যে এডিশনাল ক্যাপাসিটি কেনা-বেচার আরো দুইটি মার্কেট পরিচালনা করা হয়, তাকে বলা হয় ফ্রিকুয়েন্সি ফার্স্ট কন্ট্রোল এবং ফ্রিকুয়েন্সি সেকেন্ড কন্ট্রোল ও ফ্রিকউয়েন্সি থারড কন্ট্রোল মার্কেট।
ডে এহেড মার্কেট ও ইন্ট্রাডে মার্কেটের সুবিধা হলো, এই মার্কেট থেকে বিদ্যুৎ কেনার এক্সেস থাকলে, ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পাবে এই জন্যে ৩০% ৪০% বিদ্যুৎ ক্যাপাসিটি বানায় রাখতে হয়না। বরং কোন ধরনের কন্ট্রাক্ট না করে, এক্সেস ক্যাপাসিটি এই শর্ট টার্ম মার্কেট থেকে কেনা যায়। এর ফলে, বিদ্যুৎ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানদের বড় বড় চুক্তিতে, বা ক্যাপাসিটি কন্ট্রাক্ট করতে হবে না।
ভারতে আইসিএক্স নামক একটি প্রতিষ্ঠান শর্ট টার্ম এই বাজারটি ট্রেডিং করে। ২০২১ থেকে নেপাল আইসিএক্স থেকে শর্ট টার্ম বিদ্যুৎ কেনা শুরু করে। ভারতে বিগত এক দশকে এই শর্ট টার্ম মার্কেটটি অনেক বড় হয়েছে। এখনো এই মারকেটটি মাত্র ১০% চাহিদা পূর্ণ করে, কিন্তু, এনালিস্টরা আশা করতেছে আগামী কিছু বছরে শর্ট টার্ম মার্কেটে ৪০% থেকে ৫০% ক্যাপাসিটি কেনা-বেচা হবে।
ইন্টেরেস্টিং বিষয় হচ্ছে, আইসিএক্সের কাঠামোতে বাংলাদেশের ও বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ রয়েছে।
চিত্র ৭। ভারতের শর্ট টার্ম এনার্জি এক্সচেঞ্জ থেকে নেপাল বিদ্যুৎ ক্রয় করছে। বাংলাদেশ ও চাইলে কিনতে পারে
Indian Energy Exchange (iexindia.com)
বিপিডিবি ও আওয়ামী লিগ সরকার কিভাবে কম্পিটিটিভ মার্কেট গড়তে না দিয়ে, শুধু ক্রনিজদের সুবিধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে অস্বচ্ছ ক্যাপাসিটি মার্কেট গড়েছে
ভারতের গুণ গাওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমার উদ্দেশ্যে আপনাকে দেখানো, এই যে বিগত এক দশকে আপনাকে প্রপাগান্ডা গেলানো হয়েছে, ক্যাপাসিটি চার্জ পেমেন্ট করা বাদে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান বা বিদেশী প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রতিষ্ঠা করবে না- এইটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ক্যাপাসিটি চার্জ বাদেও ফ্লাট রেটে চুক্তি করা যায়। বাংলাদেশ নিজেই ফ্লাট রেটে ভারতের প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে, কম্পিটিটিভ বিডিং এর মাধ্যমে যে চুক্তিতে বাংলাদেশ তুলনামূলক ভাবে লাভ পেয়েছে।
এই আলোচনার আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, আপনাকে দেখানো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে ক্যাপাসিটি মার্কেট তৈরি করা হয়েছে, সেই ক্যাপাসিটি মার্কেট সম্পূর্ণ অসচ্ছ। এবং অত্যন্ত চড়া মূল্যে এই ক্যাপাসিটি কেনা হয়েছে, যার পেছনে ছিল ভয়ংকর দুর্নীতি এবং একটি অবৈধ সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্যে এলিটদের সন্তুষ্ট করার মানসিকতা।
একই সাথে বাংলাদেশে যে এক্সেস্ল ক্যাপাসিটি রয়েছে, যেইটা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে, সেখানেও বিপিডিবির সুযোগ ছিল, এক্সপায়ার করা কেন্দ্র গুলোর সাথে শর্ট টার্ম , ডে এহেড মার্কেট ও ইন্ট্রাডে মার্কেটের চুক্তি করা, যেখানে মাত্র ১০% বা ২০% সক্ষমতা ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হতো না।
এই প্রতিষ্ঠান গুলো ৫ টাকা লাভ করার সুযোগ দেখলেও তাদের কেন্দ্র গুলোকে মেন্টেন করে, ৫ টাকা লাভের সুযোগ নিতে। তাদের পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে, ৪০% এক্সেস ক্যাপাসিটি তৈরির কোন দরকার ছিল না।
এখন আমরা ফিরে আসি, কেন বাংলাদেশের সাথে আদানির চুক্তিটি অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং কেন টিম বাকলে বাংলাদেশের চুক্তি স্বাক্ষরকারীদের মোরন বলেছিল। (প্রথম পর্ব দ্রষ্টব্য)>
টিমের মূল আরগুমেন্ট হচ্ছে, ভারতের রিনিউবেল এনার্জি উৎপাদন যে পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে বাংলাদেশ সহজেই ভারতের সাথে ফ্লাট রেটে রিনিউবেল এনার্জি কেনার চুক্তি করতে পারতো। ভারত একটা এনার্জি সারপ্লাস দেশ ( ২০২২ এর কিছু গ্যাঞ্জাম হয়েছে, কিন্তু সেইটা কয়লা পরিবহন, ডিসকমদের বকেয়া টাকা পরিশোধ না করা, লাইন কেটে দেওয়া, জ্বালানী মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি কারণে, ক্যাপাসিটির স্বল্পতার জন্যে নয় )। এবং একই সাথে ভারতের রিনিউবল সোর্স আগামীতে যে পরিমাণ বৃদ্ধির প্রজেকশান রয়েছে, তার ফলে ভারতের রিনিউবলের দাম কমতেই থাকবে। ফলে, বাংলাদেশের আদানির সাথে ২৫ বছরের এই চুক্তিটি করা ছিল সম্পূর্ণ আত্মঘাতী। কারণ, যতই দিন যাবে ভারতের রিনিউবলে দাম কমতে থাকবে এবং বাংলাদেশ এই সুযোগ গুলো নিতে পারবে।
এবং রিনিউবেল যেহেতু ইন্টারমিটেন্ট সাপ্লাই দেয়, তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে রিনিউব্লের সাপ্লাই এতো বৃদ্ধি পাবে, যে অবস্থায় তাদের ক্যাপাসিটি বসায় রাখতে হবে। এবং, আইইইএ একটি গবেষণায় দেখায় যে, এপ্রিল, মে ও জুনে বাংলাদেশ যখন পিক চাহিদা, সেই সময়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে চাহিদা কমে আসে। যার ফলে বাংলাদেশ এই সময়ে অত্যন্ত চিপ প্রাইসের সুযোগ নিতে পারে। চার টাকা, পাঁচ টাকা দামের এই বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ না নিয়ে, আদানির সাথে ১৫ টাকা দামের চুক্তিকে তাই টিম বাকলে বলেছে – মোরনরাই শুধু এই চুক্তি করবে।
চিত্র ৭। বাংলাদেশের এপ্রিল, মে ও জুনের বিদ্যুতের চাহিদার সময়ে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকে।
দেন এগেইন, এইটা কমপ্লেক্স আলোচনা। বাংলাদেশ সম্পূর্ণ ভাবে ভারতের উপরে বিদ্যুতের জন্যে নির্ভরশীল হইতে পারবেনা, ৩০% উপরে ক্যাপাসিটি ভারত থেকে কেনা, আইইইএ সাজেস্ট ও করে নাই। আমাদের নিজস্ব কেন্দ্র লাগবে, নিজস্ব প্রাইমারি সোর্স ডেভেলপ করতে হবে। এবং একই সাথে আমি ঢালাও প্রাইভেটাইজ করা সমর্থন ও করিনা। আমার ফিলসফি হচ্ছে, যে সকল বিজনেসের ডিসিশান মেকিং ডাইনামিক না, সেই সকল খাতে সরকার সহজেই ব্যবসা করতে পারে। অর্থাৎ, সরকার আরএমজির ব্যবসা করতে পারবে না কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত ফিক্সড ইন্সটলেশান, যেখান ডিসিশান মেকিং স্ট্যাটিক এবং টেকনিকাল, এইসব খাতে সরকারের বিনিয়োগটাই ভালো। কারণ, বাংলাদেশে কুইক রেন্টাল নামে যে প্রকল্প হয়েছে, সেইটার দায় সম্পূর্ণ ভাবে জনগণই নিয়েছে, কিন্তু লাভ নিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যার কোন অর্থ নেই।
আমি ভারতের মার্কেটটা আলোচনা করলাম দেখাতে যে, বেসরকারি খাতে ক্যাপাসিটি চার্জের দায় নিয়ে প্রকল্প করাটাই এক মাত্র ভবিতব্য না। এবং ক্যাপাসিটির উঠা নামা ম্যানেজ করতে গিয়ে ৪০%, ৫০% অতিরিক্ত ক্যাপাসিটিকে বসায় বসায় লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিল দেওয়াও ভবিতব্য না। এমন কি ভারতের মত দেশ, বিভিন্ন শর্ট টার্ম মার্কেট, ফ্লাট রেট সহ বিভিন্ন ধরনের মার্কেট ডেভেলপ করেছে, যার ফলে অতিরিক্ত ক্যাপাসিটির পরিমাণ অনেক কমিয়ে আনা গেছে।
কিভাবে আন কম্পিটিটিভ ক্যাপাসিটি মার্কেট, আপনার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করেছে
শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ ক্রনিজ নেটওয়ার্কের একটা বৈশিষ্ট্য হলো, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে পিডিবির মনোপলি, ল্যাক অফ সাপ্লাই এবং বাংলাদেশের মিথ্যা উন্নয়নের বিভ্রম দিয়ে আনলিমিটেড সাপ্লাইয়ের পটেনশিয়াল দেখায় আওয়ামি লীগের ভাই ব্রাদার নেটোয়ার্কের যাদের বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে- এরা কেউ বিনিয়োগকারী নয়, এরা রক্তচোষা জোঁক। কারণ, বিদ্যুৎ খাতে তাদের বিনিয়োগের ফিক্সড ক্যাপিটাল, ভ্যারিয়েবল ক্যাপিটাল, কন্ট্রাক্টের নিরাপত্তা, সভ্রেন গ্যারেন্টি, আন কম্পিটিটিভ বিডিং এ সুপার নরমাল প্রফিটের সুযোগ করতে পূর্ণ অর্থ জোগান দিয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দরিদ্র জনগণ। কিন্তু তাদের নূন্যতম ঝুঁকি নিতে হয়নি। বিনিয়োগের সম্পূর্ণ দায় ভার নিয়ে ঝুঁকিটা নিয়েছে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগণ।
আইপিপিদের কন্ট্রাকটা দেয় পিডিবি, সেই কন্ট্রাক্ট নিয়ে ব্যাংক গেলেই ব্যাংক ঋণ দিয়েছে, সেই ব্যাঙ্ক ঋণের ভিত্তিতে তারা মেশিনারিজ এনেছেন। এমন কী, সেই ঋণের সুদাসল ও পরিশোধ করে বিপিডিবি। ফলে, তাদের এইখানে কোন ঝুঁকিই নিতে হয় নাই। সেই চুক্তি অনুসারে মেশিন বসে থাকলেও, তারা হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করতে পেরেছেন।
এইটা ফাংশানাল পুঁজিবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্য যে, যে ঝুঁকি কম নেবে তার রিওয়ারড কম হবে, আর যে ঝুঁকি বেশী নেবে, তার রিওয়ারড বেশী হবে- এই মূল প্রিন্সিপালটিকে কর্তৃত্ববাদী ক্ষমতার শক্তি দিয়ে শুধুমাত্র পালটেই দেওয়া হয় নাই, আদানি ও বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক লুটের আলোচনায় এই বিষয়টি সামনে আসে নাই। যার ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের এনার্জি সিকিউরিটি ধ্বংসের প্রধান ইস্যুটি আলোচনাটাই মাঠে নাই।
কিন্তু, যেহেতু টিম বাকলেরা বাংলাদেশের বলদ সাংবাদিক নন, তারা এই বৈসাদৃশ্যটি ধরতে পেরেছেন, প্রতিবাদ করেছেন। উনি কোন মতেই বিশ্বাস করতে পারতেছিলেন না যে, এর চেয়ে খারাপ কোন চুক্তি কোন দেশ করতে পারে। এবং উনি তাই বলছেন,
I am happy to be quoted, but these people are a bunch of morons.
কিন্তু, এই রিস্ক রিওয়ার্ডের যুক্তিটি মাঠে হাজির না থাকাতে আরাফাত সাহেবরা জোর গলায় বলতে পেরেছে, বাংলাদেশে আর একটি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখান, যে ১৬ টাকায় বিদ্যুৎ দিতে পারবে। কিন্তু, এই ১৬ টাকায় বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য হওয়ার দায় আরাফত সাহেবদেরই, যারা ভারতের ৫ টাকা ৬ টাকার ফ্লাট রেট বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকলেও আদানির সাথে এমন চুক্তি করেছেন, যার ফলে ১৬ তাকায় বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।
মার্কেট টাকে ডিসফাংশ্নালাল করে রেখেছেন, তাই প্রাইভেট পাওয়ার প্রডিউসারদের কাছ থেকে কেনা বিদ্যুতের মূল্য ১১ তাকায় চলে গেছে, যেখানে ভারতে ৪ টাকা ৫ টাকায় বিদ্যুৎ কেনা-বেচা যাচ্ছে।
অবশ্যই ভারতের নিজস্ব কয়লা থাকাতে সেই দাম কম পড়তেছে।
কিন্তু বাংলাদেশকে আমদানি করতে হচ্ছে কেন? কেন এখনো বঙ্গোপসাগের ১৪ বছরে তারা একটা সার্ভে করতে পারে নাই, গ্যাস উত্তোলন দূরের কথা। এর কারণ, আরাফাত সাহেবদের বন্ধু-বান্ধবদের ১৬ টাকায় বিদ্যুৎ বেচার ব্যবসা টেকায় রাখা।
ফলে এইটা এমন একটা আলোচনা যেখানে কোন দিকেই, দায় মুক্তির সুযোগ নেই। এই কারণেই কিন্তু ১৬ টাকায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনতেছে, এইটা শুনে টিম বাকলে বলেছে, দে আর আ বাঞ্চ অফ মোরনস।
-
এই আলোচনায় আরো অনেক কিছুই বলার আছে। কিন্তু, একটা পর্যায়ে আমাকে থামতে হচ্ছে। এমন কী, আমার অন্যান্য অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা, এই প্রকল্পের গবেষণা করতে গিয়ে থেমে গ্যাছে। তাই আমি থামলাম।
সবাই ভালো থাকবেন।
চমৎকার আলোচনা। আপনি অনেক পরিশ্রম করেছেন বস, আল্লাহ আপনাকে এজন্য উত্তম পুরস্কার দিবেন ইনশআল্লাহ।
ছোট একটা প্রশ্ন: আদানির সাথে চুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের কি আর কিছুই করার নাই? মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে?
ক্যারি অন ভাই। আমার আপসোস লাগছে সাকী ভাইকে, আরাফাত সাহেবের সাথে বসানো হলো। এসব জায়গায় ডয়েচে ভেলে আপনাকে নিলে আরাফাত সাহেবের কোন পালটা আর্গুমেন্ট ছিল কিনা বোঝা যেত। তবে ১৩ বছরে, বেশ কিছু সার্ভে হয়েছে বলে কিন্তু সাকসেস আসেনি বলে কিন্তু বিপু সাহেব দাবী করেন।