এই লেখাটার ভিত্তিতে তৈরি ভিডিও এখানে। সাবস্ক্রাইব করার অনুরোধ রাখছি।
দুইটা তথ্য দিচ্ছি, সম্পূর্ণ আনরিলেটেড মনে হইলেও, তথ্য দুইটা কানেক্টেড। অনেক হইচই আর বাদ্য বাজিয়ে পেনশন স্কিমের উদ্বোধনের পরেও, প্রথম এক মাসে মাত্র১২,৯৭০ জন লোক রেজিস্টার করেছে , যেইটা থেকে সরকার মাসে সর্বোচ্চ ৪ কোটি টাকার মত পাবে। এই টাকা দিয়ে সরকার নেশনাল পেমেন্ট অথরিটি নামের যে সংস্থাটি তৈরি করা হয়েছে, তার কর্মকর্তাদের চা বিস্কিটের টাকাও হবেনা।
দ্বিতীয় তথ্য হচ্ছে, বেসরকারি কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের বেতন থেকে কেটে ভবিষ্যতের জন্যে যে প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা জমান, সেই প্রভিডেন্ড ফান্ডের বিনিয়োগের মুনাফার উপরে সরকার ২৭.৫% ট্যাক্স নির্ধারণ করেছে।
আপনি বলতে পারেন, এই দুইটার মধ্যে কোন কানেকশান নাই। আমার দ্বিমত আছে।
এই দুইটার সম্পর্ক স্থাপনের আগে একটু বলি, যে প্রভিডেন্ড ফান্ডের উপরে ২৭.৫% ট্যাক্স নির্ধারণে তিনটা ভয়ংকর জুলুম হয়েছে।
জুলুম ১ ,এই টাকাটা বেসরকারি কোম্পানির চাকুরিজীবীরা প্রতি মাসে তাদের বেতন থেকে কেটে জমায়। তাদের অফিস সম পরিমাণ টাকা দেয়। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পেনশন নামে কিছু নাই। কিন্তু, অনেক প্রতিষ্ঠানে এই প্রভিডেন্ড ফান্ডটা আছে। এইটা একটা মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়।
যেহেতু মূল্যস্ফীতি নিজেই সঞ্ছয়ের উপরে একটা ট্যাক্স। তাই এই সঞ্ছয় থেকে বিনিয়োগে যদি মূল্যস্ফীতির চেয়ে বেশী লাভ হয় তবে, বছর বছর এই টাকাটা ব্রদ্ধি পায়।
কিন্তু, বাংলাদেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির উপরে সরকার যখন ২৭.৫% হারে ট্যাক্স কেটে রাখবে তখন এমন একটা সিচুয়েশান হতে পারে যে, চাকুরি জীবন শেষে একজন এক জন কর্মচারী যা পাবে, সেইটার প্রকৃত মুল্য তার বিনিয়োগের থেকে কম।
ফলে এই ট্যাক্সটা একটা জুলুম।
দ্বিতীয়ত, যদি আপনি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ডে হাত দিবেন, তাইলে শুধু বেসরকারি কেন ? কেন সরকারী কর্মচারীদেরকেও নয় ?
কিন্তু, শুধু তাই না, সরকার নিজেই সরকারী কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ডে ১৩% সুদ দেয় যেইটা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সুদের রেট।
তো এক দিকে আপনি বেসরকারি কর্মচারীদের পিশে তাদের জ্যুস বের করে নিচ্ছেন, তাদের বুড়ো বয়সের অর্থে হাত দিচ্ছেন, কিন্তু, আরেক দিকে সরকারী কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ডে ১৩% হারে, সুদ দিচ্ছেন। সেই সুদের টাকাটা আসতেছে কিসের থেকে ? কিছুটা হলেও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কেটে নেওয়া আয়কর থেকে।
তৃতীয়ত , এই ট্যাক্সের মাধ্যেমে সরকার প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স সিস্টেমের নীতি ভংগ করেছে।
কারন বাংলাদেশের যার আয় বেশী, তার ট্যাক্স বেশী। কিন্তু, প্রভিডেন্ড ফান্ডের মুনাফার উপরে ফ্লাট ২৭.৫% ট্যাক্সের মাধ্যমে আপনি একটা প্রতিষ্ঠানের ৫ লক্ষ টাকা বেতন পাওয়া এমডি, আর ১৫ হাজার টাকা বেতন পাওয়া পিয়নের কাছ থেকে একই হারে ট্যাক্স কাটলেন।
ফলে কি হলো ? এক দিকে আপনি বেসরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে কর্মচারীর অংশ করযোগ্য আয় হিসেব ধরে নিয়ে, সেইটার উপরে প্রতিটা পয়সা আয়কর নিলেন। অন্য দিকে আপনি, সেই আয়ে এমডি আর পিয়ন দুই জনের আয় থেকেই তিন ভাগের এক ভাগ কেটে নিলেন।
এইটা ভয়ংকর জুলুম।
আর প্রশ্ন হচ্ছে, এক বেসরকারি কর্মচারীদের কত পিশবেন।
বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে টিন সারটিফিকেট আছে ৯০ লক্ষ লোকের। ২০২৩ এর জুন পর্যন্ত এর মধ্যে ৩৪ লক্ষ লোক রিটার্ন সাবমিট করেছে। এই ৩৪ লক্ষ লোকের মধ্যে বড় অংশ বেসরকারি কর্মচারী।
সরকার যেইটা করতেছে, যারা আয়কর দিচ্ছে , তাদেরকেই চুষে নিচ্ছে। এবং চোষার একটা নতুন পদ্ধতি হইলো প্রভিডেন্ড ফান্ডের প্রফিটের উপরে ২৭.৫% ট্যাক্স।
অথচ এই বেসরকারি কর্মচারী কিছুই পায় না। ২০১৬ সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল মুহিতের দেওয়া একটা হিসেব অনুসারে, বাংলাদেশের শুধু মাত্র ৬% বেসরকারি কর্মচারী গ্রাচুইটি ও প্রভিডেন্ড ফান্ড পায়। ফলে সরকারের টারগেট মূলত এই ছোট গ্রুপটাকেই চুষে নেওয়া।
সরকার এইটা কেন করতেছে ?
সেইটার কারনও আবার সেই সরকারী কর্মচারী। ২০২৩ এর জুনে ফোরাম ফর বাংলাদেশের বাজেট এনালিসিসে আমি দেখিয়েছি, মেগা প্রজেক্ট নয় বরং বাংলাদেশের মেগা প্রজেক্ট নয়, ১৬ লক্ষ কর্মচারীর বেতন, ভাতা, তাদের পেছনে রিকারিং এক্সপেন্স সহ বিবিধ খরচের জন্যে বাংলাদেশ সরকার জনগণের উপরে এই দায় গুলো চাপাচ্ছে। এই আলচনায় আমি দেখিয়েছি, মেগা প্রজেক্টের ব্যায়ের চেয়ে প্রশাসনের প্রশাসনিক ও রিকারিং ব্যয় ৭ গুন বেশী।
আমি দেখিয়েছি যে, ২০২৩ সালে মেগা প্রজেক্টের পেছনে ব্যয় যেখানে ৬০ হাজার কোটি টাকা সেখানে প্রশাসনের পেছনে রিকারিং এক্সপেন্স ৪,৭২ লক্ষ কোটি টাকা যার মধ্যে, শুধুমাত্র ১৬ লক্ষ কর্মচারী আর প্রসাশনের পেছনে ব্যয় ২.২৩ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২৩ এ ৩৭% বা ৬০ হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে ।
অর্থাৎ, এতো দিন যে আপনি শুনেছেন, মেগা প্রজেক্ট করতে গিয়ে, আমদানি করতে গিয়ে বাংলাদেশ ফতুর হয়ে যাচ্ছে সেই ধারনাটা ঠিক নয় বরং প্রশাসনের ১৬ লক্ষ কর্মচারিকে পুষতে গিয়ে বাংলাদেশ ফতুর হয়ে যাচ্ছে।
এদেরকে খুশি করতে ৩.৩০ লক্ষ কোটি টাকা আয় করে সরকার ৭ লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করতেছে।
ফলে, সরকার সাধারণ মানুষের অতীত বর্তমানকে চুষে, টাকা ছাপিয়ে , ব্যাংক ঋণ নিয়ে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা অর্থ জোগাড় করতে পাগল হয়ে গিয়েছে ?
ফলে, তাকে টাকা ছাপাইতে হচ্ছে, ঋণ করতে হচ্ছে। একই সাথে মিথ্যা জিডিপি দিয়ে, ট্যাক্স জিডিপি কমা দেখায় বলতেছে ৩ লক্ষ কোটি টাকা তো মাত্র জিডিপির ৮%। কিন্তু সেই টা আয় করতেই, আপনার ব্যাংক একাউন্ট, , মোবাইল ফোনের বিল, চিনি আমদানি সব জায়গাতেই সে মাত্রাতিরিক্ত ট্যাক্স বসাইছে। সেইটাতেও তার ঘাটতি মিটতেছেনা, এখন সে তাই বেসরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ড ফান্ড টার্গেট করেছে।
২০২৩ সালে মাত্র ৩৩,৯০৫টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ট্যাক্স রিটার্ন দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান গুলোর খুব ছোট একটা অংশের প্রভিডেন্ড ফান্ড রয়েছে। কিন্তু এই ফান্ড গুলোতে বড় অংকের টাকা আছে, সরকার সেই ফান্ড গুলো টার্গেট করেছে।
তো আসেন প্রথম প্রশ্নটার উত্তর দেই। আমি কেন বললাম যে , প্রভিডেন্ড ফান্ডের মুনাফার উপরে ২৭.৫% আয়কর আরোপ আর পেনশন স্কিমের প্রথম মাসে মাত্র ১৩০০০ ব্যক্তির রেজিস্ট্রেশান করার তথ্য দুইটা কেন সংযুক্ত ?
এই থিয়োরিটা ডক্টর জাহেদ ভাই সহ অনেককেই আমি বলতে শুনেছি যে , টাকার খোজে দিশেহারা বাংলাদেশ সরকার এক সময় জনগনের জন্যে পেনশন স্কিম বাধ্যতামূলক করে দেবে।
কিন্তু আমি ভাবতেছিলাম এইটা কেমনে সম্ভব ?
আমি ভাবতেছিলাম যে , যে চারটা স্কিম আছে তার মধ্যে প্রবাসীদের জন্যে প্রবাস, , অপ্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের জন্যে সুরক্ষা ও স্বল্প আয়ের ব্যক্তিরদের জন্যে সমতা স্কিমের জন্যে কাউকে সরকার বাধ্য করতে পারবেনা।
কিন্তু আমি ভাবতেছিলাম যে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকার চাপ দিতে পারে।
কিন্তু, তাও ভাবলাম যে, এই চাপটা দিলেও তো আইনগত ভাবে বাধ্য করতে পারবে না।
কিন্তু, প্রভিডেন্ড ফান্ডেের মুনাফার উপরে ২৭.৫% আয়কর চাপানোর নিউজ টা শুনে আমার মাথায় প্রথমেই আসছে যে এই যে সরকারের স্কিম বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
যেহেতু প্রভিডেন্ড ফান্ডের এমপ্লয়ি কন্ট্রিবিউশান ম্যান্ডেটরি না, এইটা কর্মচারির চয়েজ , সরকার চাইতেছে বেসরকারি কর্মীদেরকে তাদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা , সরকারের পেনশন ফান্ডের দিকে নিয়ে যাইতে।
আপনি বলতে পারেন যে, প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকায় এমপ্লয়ি কন্ট্রিবিউশানের সম পরিমাণ অর্থ, অফিস দেয় -ফলে ২৭.৫% কেটে নেওয়ার পরেও ফান্ডের রিটার্ন, পেনশান ফান্ডের রিটার্ন থেকে বেশী হবে।
কিন্তু, সরকার যেইটা আর্গুমেন্ট দেবে তা হলো, প্রভিডেন্ড ফান্ডে বিনিয়োগ করলে একজন কর্মচারী একটা ফিক্সড এমাউন্ট পাবে কিন্তু এই টাকা পেনশন ফান্ডে দিলে, পেনশন পাবে লাইফ টাইম । ফলে প্রভিডেন্ড ফান্ডে টাকা না জমায়, পেনশন স্কিমে নিয়ে আসো।
ফলে দেখবেন, আগামীতে সরকার ধীরে ধীরে বেসরকারি কর্মিদের পুশ করতে থাকবে, প্রভিডেন্ড ফান্ডের বদলে টাকা পেনশন ফান্ডে রাখতে।
কারন সরকারের টাকা দরকার। ১৪ লক্ষ আকাইম্মা সরকারী কর্মচারীর গাড়ি, গাড়ির ড্রাইভার, তাদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের সুদ, ৫% রেটে হাউজ লোনের বাকি অংশের সুদ, তাদের বিদেশ যাত্রা, তাদের অফিসের মেন্টেন্স সহ যে ৪.৭২ লক্ষ টাকার রিকারিং কষ্ট, ৪ লক্ষ কোটি টাকা আয় করে, ৭ লক্ষ কোটি টাকা খরচ করে- ৩ লক্ষ কোটি টাকা যে গ্যাপ সেইটা পূর্ণ করতে সরকারের আয় বাড়াইতে হবে।
এইটার জন্যে এক দিকে সে ২৭.৫% ট্যাক্স বসায় তার আয় পুরা করবে, আরেক দিকে পাব্লিককে পেনশন স্কিম কিনতে বাধ্য করে সেই ঘাটতি মেটাবে।
তার ধান্দা এইটাই।