আরজেন্টিনার ধনীরা টাকা পেলে ইট কেনে। কেন বাংলাদেশেও অনেকে তাই করছে?
আরজেন্টিনাতে মানুষ ব্যাংকেও টাকা রাখে না, হাতেও রাখে না। কিন্তু টাকা হাতে এলেই ইট কিনে রাখে। বাংলাদেশেও কি এমন পরিস্থিতি হতে পারে যে, হাতে টাকা এলে আপনাকেও ইট কিনতে হবে ?
এই আলোচনাটা চাইলে আপনি ইউ ইউটিউবেও শুনতে পারেন, এই লিংকে
টাকার বদলে ইট জড়ো করার কারণ আরজেন্টিনা বর্তমানে একটা গভীর আর্থিক সংকটে রয়েছে। কিন্তু, এমন হওয়ার কথা ছিলনা। মাত্র ১০০ বছর আগে আরজেন্টিনা ফ্রান্স বা ইতালির চেয়ে বেশী ধনী ছিল। এমনকি, কলোনিয়াল ইংল্যান্ড পর্যন্ত প্রয়োজনে আরজেন্টিনার থেকে টাকা ধার করতো। আর আরজেন্টিনার এই পতনের পেছনে দায়ী একজন জনপ্রিয় নেতার আর্থিক পলিসি।
এই নেতার পলিসি, আরজেন্টিনাতে যে সংকট তৈরি করেছে, তার সাথে বাংলাদেশে যার নাম বললে চাকুরি থাকবেনা, সেই নেতৃর নয়া বাকশাল ২.০ এবং তার পিতার বাকশাল ১ এর অনেক মিল আছে, যে মিল গুলোর কারণে হয়তো আপনাকেও কিছু দিন পরে টাকা পেলেই ইট কিনতে হইতে পারে।
তাকিয়ে দেখেন , বাংলাদেশর কিছু ধনী ব্যক্তি কিন্তু এখনই টাকা ইট কেনা শুরু করেছে। অনেকেই আমার কাছে ফিনানসিয়াল এডভাইজ চান। ফ্রি-তে একটা এ্যাডভাইজ দিচ্ছি- মেবি, আপনিও ইট কেনা শুরু করেন । এটা ভালো এডভাইস।
ব্যাংকে টাকা না রেখে, ইট কেনা কেন আপনার জন্যে ভালো এ্যাডভাইজ, এইটা বুঝতে হলে আপনাকে আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকট, সংকটটা কীভাবে তৈরি হলো , সংকটের উত্থানের সাথে বাকশাল ১ ও ২ এর মিল-অমিল গুলো বুঝতে হবে।
কিন্তু এর আগে আমরা দেখি কেন আর্জেন্টিনার অর্থনৈতিক সংকট এমন অবস্থায় গিয়েছে যে, মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে ইট কেনে।
Section আর্জেন্টিনার গভীর আর্থিক সংকট
আরজেন্টিনা আর্থিক পরিস্থিতি আসলে খুবই খারাপ। এতই খারাপ যে, প্রায়ই দেনার দায়ে বিভিন্ন দেশে আরজেন্টিনার বিমান বা জাহাজ আটকে রাখে। ২০১২ আমেরিকার যেএফকে এয়ারপর্টে মার্কিন আদালতের নির্দেশে, রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা, এরোলাইনসের দুইটি প্লেইন আটক করা হয় । ২০১৪ সালে ঘানায় আটক করা হয় আর্জেন্টিনার জাহাজ ARA Libertad। ২০১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় আর্জেন্টিনার নেভির একটি জাহাজ পর্যন্ত আটকে রাখা হয়।
কিন্তু সেইটা তো রাষ্ট্রীয় দায়, কিন্তু আরজেন্টিনার মানুষ ব্যাংকের টাকা রাখার বদলে ইট কেনে কেন ?
আমি তিনটা কারন বলবো, আর আপনারা কমেন্টে জানাবেন এর মধ্যে কোনটির কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে ইট কেনে।
সংকট ১- মূল্যস্ফীতি
ছবিতে আপনি দেখতে পাচ্ছেন, ২০২৩ এ আর্জেন্টিনার মূল্যস্ফীতি ১১৫% এ পৌঁছেছে।
এইটা বোঝা আরো সহজ হয়, খাবারের দাম দেখলে। নীচের ছবিতে মাত্র তিন বছরে একটা বার্গারের দাম কী পরিমাণ বেড়েছে তা দেখলে ১১৫% মূল্যস্ফীতির ব্যপ্তি ধারণা করা সহজ হবে।
২০২০ থেকে ২৩ এ একটা বার্গারের দাম ডবল হয়ে গিয়েছে।
দ্বিতীয় সংকট- একাধিক এক্সচেঞ্জ রেট
অফিসিয়ালি, ব্যাংকে গেলে ২০০ পেসোতে ১ ডলার পাবেন। কিন্তু, আনঅফিসিয়ালি এক ডলারে কিন্তু আপনাকে ৮০০ পেসো দিতে হবে। অর্থাৎ, অফিসিয়াল আনঅফিসিয়াল রেটের মাঝে গ্যাপ ৪০০% এ পৌঁছেছে,
তৃতীয় সংকট- রিজার্ভ
আরজেন্টিয়ান রিজার্ভ ২০২০ সাল থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার থেকে, ২০২২ এ ২৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে
বাংলাদেশের মত অবস্থা রাইট ?
ফিগারটা কিন্তু বাংলাদেশের মতোই। মাত্র দুই বছরে ৪৫ বিলিয়ন থেকে ২০ বিলিয়নে নেমে আসা।
এখন আমাকে জানানতো, একশো পারসেন্ট ইনফ্লেশান, পেসোর অফিসিয়াল মূল্যের সাথে আন অফিসিয়াল দামের ৪০০% পার্থক্য, রিজার্ভের পতন- এই তিন টা সংকটের মাঝ্যে কোনটির প্রভাবে লিওনার্দো মেসির দেশ আর্জেন্টিনার মানুষ ব্যাংকে অর্থ জমা না রেখে, ইট কেনে?
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আরজেন্টিনার এই অবস্থা কেন হলো?
আরজেন্টিনার ইতিহাস
বিগত শতকের শুরুতে, আরজেন্টিনার পার ক্যাপিটা ইনকাম ফ্রান্স, ইতালি, কলোনিয়াল ব্রিটেন থেকেও বেশী ছিল। খনিজ, কৃষি ও পশু সম্পদে সমৃদ্ধ ভরপুর আর্জেন্টিনা ছিল দক্ষিণ আমেরিকার এমন একটা দেশ যেখানে ইউরোপের গরীব লোকেরা আসতো লেবারি করতে ।
কিন্তু এই স্বর্ণযুগ চিরস্থায়ী হতে পারেনি।
আরজেন্টনার স্বর্ণযুগ শেষ হয়ে পতনের শুরু হয় একজন নেতাকে দিয়ে। এই নেতার নাম হুয়ান ডমিঙ্গো পেরন। পেরনের আর্থিক পলিসিকে বলা হয় পেরনিজম যদিও আরজেন্টিনার আর্থিক সংকটের পেছনে পেরনিজমের বড় ভূমিকা বুঝতে অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু, তারপরও
পেরন অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। উনার শাসনামলে তার পতনের অপেক্ষায় কেউ তাহাজ্জুধের নামাজ পড়তো না। আর এখনো পেরনকে আরজেন্টিনার কোটি কোটি মানুষ ভালোবাসে।
আধুনিক আরজেন্টিনার জাতির পিতা হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরনের উত্থান
হুয়ান ডোমিঙ্গি পেরনের উত্থানের ইতিহাস একটা দীর্ঘ গল্প, জটিল গল্প। যেইটা বুঝতে হলে আমাদের আরজেন্টিনায় স্প্যানিশা কলোনালিয়াজম, নিও কলোনালিয়াজিম, স্প্যানিশদের রেখে যাওয়া আরজেন্টিনার ক্ষুদ্র জমিদার শ্রেণীর সাথে আদিবাসী, দরিদ্র ইউরোপীয় অভিবাসী ও দাসদের মধ্যে যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, এইটার অনেক আলাপ করতে হবে। এই আলাপ পরে করবো। আজকে আমরা শুধু আর্থিক সংকট বুঝতেছি।
বিশ্বের সব চেয়ে ধনী দেশ গুলোর মাঝে একটি হলেও আরজেন্টিনাতে ছিল ব্যাপক বৈষম্য। কলোনিয়লাইজম শেষ হলেও আরজেন্টিনার ট্রাডিশোনাল ভূমি মালিক এলিট ও ইন্ডাস্ট্রিইয়াল অলিগারকদের হাতে আরজেন্টিনার ওয়ারকিং ক্লাস আদিবাসি, দরিদ্র ইউরোপীয় অভিবাসী ও দাসেরা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল দশকের পর দশক।
আরজেন্টিনাতে ১৯১২ সালে সর্বজনীন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু, সাদা ইমিগ্রেন্ট ও দাস, যারা কিনা ওয়ারকিং ক্লাস পিপলের ৫০%, তাদের কোন পলিটিকাল রাইটস বা ভোটের অধিকার ছিল না।
১৯১৬ সালে হিপোলতা রিগয়েন ক্ষমতায় আসে। যেহেতু ওয়ারকিং ক্লাসের বড় অংশ ভোটার নয়, ফলে হিপোলতা রিগয়েন মূলত মিডল ক্লাসকে তুষ্ট রাখার নীতি নেয়।
কিন্তু, আরো ২০/৩০ বছর পরে এই ওয়ারকিং ক্লাস ইমিগ্রেন্টদের সন্তানেরা যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে, তখন তাদের ভোটাধিকার ছিল। ৪০ এর দশকের দিকে আরজেন্টিনাতে ওয়ারকিং ক্লাস এর পলিটিকাল প্রাধান্যতা তৈরি হয়, এবং এই পলিটিকাল ক্লাসের প্রতিনিধিত্ব করতে সামনে আসে হুয়ান ডোমিঙ্গো পেরন।
১৯৩০ সালে আর্মি ক্যু এর মাধ্যমে হিপোলতা রিগয়েনকে সরায়। এই সময়য় পেরন ছিল একজন মাঝারী পর্যায়ের মিলিটারি অফিসার, যাকে মিনিস্ট্রি অফ লেবারের একটা শাখার প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় যে পদের আগে কোন গুরুত্ব ছিলনা। এই সময়ে ট্রেড ইউনিয়ানের সাথে, বিজনেসের নেগোসিয়েশানে পেরন সব সময়ে শ্রমিকদের পক্ষ নেয় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওয়ারকিং ক্লাসদের পক্ষে থাকায় পেরন একজন কর্মকর্তা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ফলে পেরনের জনপ্রিয়তা দেখে যখন তাকে স্যাক করা হয় তখন পেরনকে ফিরিয়ে আনার দাবীতে আরজেন্টিনিয়ান শ্রমিক সংগঠন জেনারল কনফেডারেশান অফ ওয়ারকারসদের এসোসিয়েশানের মাধ্যমে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হয়।
এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আরজেন্টিনায় গণতন্ত্র ফিরে আসে, এবং ৪৬ এ পেরন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়।
পেরনের শাসনামল
ক্ষমতায় এসে পেরন তার পূর্বের প্রশাসনের অলিগারকি তোষণ নীতির বিপরীতে গিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র তৈরির উদ্যোগ নেয়।
পেরন সবার জন্যে ফ্রি চিকিৎসা ও শিক্ষা, সর্বোচ্চ ৮ কর্মঘন্টা, পেইড লিভ, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্যে বাসা সহ অনেক উদ্যোগ নেয় যা সেই সময়ে বিশ্বের খুব কম দেশেই ছিল।
একই সাথে পেরন অনেক জ্বালানি, ইউটিলিটিজ, ট্রান্সপোর্ট সহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি জাতিয়তাকরন করে। উদাহরন স্বরূপ আরজেন্টিনার রেললাইনের ৬০% মালিকানা ছিল ব্রিটেনের। এই গুলো সব পেরন সরকারীকরন করে।
একই ভাবে পেরন সরকারী কর্মচারীদের নিয়োগ বৃদ্ধি করে। সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি করে।
গরুর মাংস সহ বা বিভিন্ন ধরনের পণ্যের রপ্তানির উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যেন জনগন সস্তায় গরুর মাংস খেতে পারে। পেরনের আমলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি এই গুলোর খরচ উৎপাদনের চেয়ে কম মূল্যে পাব্লিকের কাছে বিক্রয় করা হয়। তো পেরন বলতেছিলেন যে, ক্যাপিটালিজম ও সোশালিজমকে ব্যাল্যান্স করে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার একটা নতুন ধারনা তৈরি করেছেন, যেটা এখন পেরনিজম নামে পরিচিত।
পেরনিজমের পতন
প্রথম দিকে অর্থনীতি বুম করে। মানুষ আনন্দিত। কিন্তু, এইটার পতন ও দ্রুত আসে।
আয়ের চেয়ে বেশী ব্যয় করার ফলে কয়েক বছরের মধ্যে আরজেন্টিনার বাজেট ডেফিসিট শুরু হয়। সেই বাজেট ঘাটতি মেটাতে শুরু হয়, টাকা ছাপানো।
একই সাথে, প্রডাক্টিভিটি হ্রাস পায়, প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট বন্ধ হয়ে যায় – মাত্রাতিরিক্ত মূল্যস্ফীতি শুরু হয়। পেরন মূল্যস্ফীতির জন্যে কালোবাজারি, মজুতদার ও চোরাকারবারিদের দোষ দেওয়া শুরু করে আর সমাধান হিসেবে বাজারের উপরে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরো বৃদ্ধি করে এবং বিভিন্ন জিনিস্যের প্রাইস নিধারন করা শুরু করে। এর ফলে পরস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকে।
কিন্তু,সেই যে পতন শুরু আরজেন্টিনের অর্থনীতি সেই পতন থেকে আর ৭০ বছরে উঠে দাঁড়াতে পারেনি।
বাই দা ওয়ে, পেরনিজের আর্থিক পলিসিতে আপনারা কি বাকশাল ১ আর ২ এর মিল আর অমিল গুলো দেখতে পাচ্ছেন?
কেন পেরনিজমের কারণে আরজেন্টিনার অর্থনীতি ধ্বংস হলো?
আপনি বলতে পারেন জিয়া ভাই,
কিন্তু কেন পেরনিজম এই পতন ডেকে আনলো? পেরন যে স্টেপ গুলো নিয়েছিল সেই গুলোতো একটা রাষ্ট্রের জন্যে প্রয়োজনীয়, তাহলে কেন পেরনিজমের হাতে আরজেন্টিনার সমৃদ্ধ অর্থনীতি ধ্বংস হলো?
কোন সন্দেহ নেই, স্পেনিশদের রেখে যাওয়া জমিদারদের কারটেল, বিজনেস অলিগারক ও এলিটদের হাতে আরজেন্টিনার ওয়ারকিং ক্লাস যেভাবে রাজনৈতিক, অর্থনীতিক, সামাজিক, প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে শোষিত হচ্ছিল, সেই নিউকলোনালিয়াজমের বিপরীতে পেরন আরজেন্টনিয়ান ওয়ারকিং ক্লাসকে খমতায়ন করেছে।
এবং পেরনের সামাজিক পলিসি, আইন এবং শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ উন্নয়নের পদক্ষপ গুলো কোটি কোটি মানুষকে দারিদ্রতা থেকে বের করে এনেছে।
কিন্তু সেইটা পেরন করেছে, অতিরিক্ত সরকারী খরচের মাধ্যমে যার ফলে সরকারকে টাকা ছাপানো শুরু করতে হয়।
একই সাথে পেরন অপ্রয়োজনীয়ভাবে জরুরি ইন্ডাস্ট্রি জাতীয়তাকরন করেছে, যার ফলে ইন্ডাস্ট্রি গুলোতে কম্পিটিশন কমে গিয়ে প্রডাক্টিভিটি হ্রাস পায়।
পেরনের বিভিন্ন জন তোষণের নীতির কারণেও কম্পিটিটিভনেস কমে আসে। উদাহরন দেই,
পেরন গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন যে দাম আন্তর্জাতিক দাম থেকে কম ছিল। ফলে কি হওয়ার কথা? দাম কমে গেলে কম দামে সেইটা রপ্তানি হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু উনি রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দিলেন। ফলে, গরুর খামারিরা কম দাবে গরুর মাংস বেচতে বাধ্য হইলো।
ফলে আরজেন্টিয়ানরা তার প্রতিবেশি দেশের চার ভাগের এক ভাগ দামে গরুর মাংস খেতে পারতো, কিন্তু খামারিদের লস হওয়াতে তারা উৎপাদন কমিয়ে দিলো।
ফলে অর্থনীতিবিদেরা এইটা বলেছন যে ওয়ারকিং ক্লাসের মুভমেন্ট হইলেও পেরনিজম মূলত আরবান ইন্ডাস্ট্রিয়াল অয়ারকিং ক্লাসকে বেনেফিট দিয়েছে, কৃষক, দিনমজুর সহ ইনফরমাল লেবার যারা, তারা বেনেফিট পায় নাই।
একই সাথে তিনি রপ্তানি মুখী শিল্পের বদলে উঁচু ট্যাক্স দিয়ে ইমপোর্ট সাবস্টিউশান ইন্ডাস্ট্রিতে জোর দেন। সেই সময়ে স্পষ্ট ছিলনা যে আমদানি প্রতিস্থাপন শিল্প কীভাবে অর্থনীতিক সংকট ডেকে আনতে পারে।
আরজেন্টির বাকশাল পেরনিজমের হাতে ধ্বংস অনিবার্য ছিল।
পেরন মূলত একজন স্বৈরশাসক ছিলেন, যাকে ল্যাটিন আমেরিকার ভাষায় বলা হয় Caudillo। কডিলো হচ্ছে এক ধরনের নেতা যারা মিলিটারি ও পলিটিকাল পাওয়ার দিয়ে তাদের নেতৃত্বের কাল্ট তৈরি করেন। উনি নিউজ পেপার বন্ধ করে দেয় এবং আইন করে আরজেন্টিনার প্রেসিডেন্টের যে টার্ম লিমিট আছে সেইটা তুলে দেয়।
পেরন ফ্যাসিস্টদের দ্বারা ইন্সপায়ারড ছিল। চাকুরীর শুরুর দিকে পেরন ট্রেনিং নিতে মুসোলিনির ইতালিতে গিয়েছিলেন, যেটার থেকে পেরন ফ্যাসিস্ট ইডিওলজির উপরে আস্থা রাখতেন।
পেরনের সরকারের তিনটা নীতি।
১। রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ত্ব ,
২। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং
৩। সামাজিক ন্যয়বিচার
উনি একটা শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার তৈরি করতে চেয়েছিলেন যে পাব্লিকের সকল দিক নিয়ন্ত্রণ করবে। পেরন বলতেন যে এইটা ক্যাপিটালিজ ও স্যোশালিজমের বিপরীতে একটা তৃতীয় পন্থা। কিন্তু, অধিকাংশ বিশ্লেষক এক মত যে পেরনিজম একটা ডানপন্থি মুভমেন্ট, যদিও গ্লোবাল লেফটের পেরনিজমের প্রতি মোহ রয়েছে।
পেরন যখন মারা গিয়েছে তখনও তিনি জনপ্রিয় ছিলেন, আমাদের সময়ের মত আরজেন্টিনিয়ান জনগণ রাত দিন তাহাজ্জুদ পরে তার পতন কামনা করে নাই, কারন শাসন আমলে পেরন আরজেন্টিনেয়ানদেরকে সস্তা গরুর গোস্ত ও উঁচু বেতন দিয়ে গ্যাছে। কিন্তু, অর্থনীতিবিদেরা মোটামুটি একমত যে, পেরনের পলিসি গুলোর আর্জেন্টিনার ধ্বংসের বিজ বপন করে গিয়েছে।
ইন শর্ট বলা যায়, প্রাইস কন্ট্রোল, অথরেটেরিনিজম, শক্তিশালী পুলিসি রাষ্ট্র, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ, আজীবন ক্ষমতায় থাকা, টাকা ছাপানো, মূল্যস্ফীতি তৈরি, মূল্যস্ফীতির জন্যে কালোবাজারিকে দোষ দেওয়া, সরকারের খরচ বৃদ্ধি, সরকারী কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি, অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া- পেরনিজমের যে খারাপ দিক গুলো দেখতে পেয়েছেন তার সবই বাকশাল ১ ও বাকশাল ২ এ আমরা দেখতে পেয়েছি।
কিন্তু অমিল হচ্ছ, পেরনিজম ছিল অলিগারকদের বিরুদ্ধে ওয়ারকিং ক্লাসের শাসন কিন্তু বাংলাদেশের বাকশাল ২.০ অলিগারকদের রক্ষার জন্যে ওয়ার্কিং ক্লাসের বিরুদ্ধে শাসন। এই জন্যে সরকার চা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তাদের অন্যায্য বেতন মেনে নিতে বাধ্য করে, পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন দমিয়ে রাখে, শ্রমিক নেতা হত্যা করে, তাদের নেগোসিয়েশান গোয়েন্দা সংস্থা লাগিয়ে বেতন কম রাখে, বেসরকারি কর্মীদের কিছু দেয় তো না উল্টো তাদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের আয়ের উপরে ইন্টেরেস্ট বসায়।
ফাইনালি পেরনিজমের সাথে যে মিলটা দেখি তা হচ্ছে, একটা শক্তিশালী অর্থনীতি পেলেও সেইটাকে মাত্রাতিরিক্ত যথেচ্ছারের মাধ্যে আর্থিক ক্রাইসিসের দোরগোড়ায় নিয়ে আসা। আওয়ামি লীগ ২০০৯ এ যখন ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশে ছিল একটা একটা প্রকৃত উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। কিন্তু বিগত এক দশকে উন্নয়নের নাম এই দেশটাকে চুষে একটা আর্থিক ধবসের প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
পেরন ও মাত্রাতিরিক্ত খরচ ও সুবিধা দিয়ে একটা সমৃদ্ধ রাষ্ট্রকে ধংসের গড়গোঁড়ায় নিয়ে এসেছে- মিল কিন্তু এতো টুকুই। আর অমিলটা হচ্ছে, সেইটা পেরন করেছিল দেশের মানুষের জন্যে, ওয়ারকিং ক্লাসের জন্যে, অলিগারকদের বিরুদ্ধে । কিন্তু, শেখ হাসিনার আওয়ামি লীগের নীতি অলিগারকদের পক্ষে, ওয়ারকিং ক্লাস ও মিডিল ক্লাসের বিরুদ্ধে।
কিন্তু ওয়েট আমাদের প্রথম প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি।
আরজেন্টিনার মানুষ ইট কেনে কেন?
এর কারন আরজেন্টিনার মূল্যস্ফীতি।
আরজেন্টিনাতে ১০০% এর উপরে মূল্যস্ফীতি। এইটা অফিস্যাল রেট। কিন্তু আনঅফিসিয়ালি মূল্যস্ফীতি আরো অনেক বেশী। ফলে, যদিও আরজেন্টিনার ব্যাংকের সুদের হার ১০০% এর উপরে, যেহেতু মূল্যস্ফীতি আরও বেশী, তাই আরজেন্টিনার মানুষ মনে করে যে ব্যাংকে টাকা রাখলে, তাদের টাকার কোন মূল্য থাকবেনা।
ফলে আরজেন্টিনার লোক ডলার, বিটকয়েন ইত্যাদিতে অর্থ রাখে।
কিন্তু ডলার তো এভেলেবল না। ব্যাংকে গেলে ব্যাংক আপনাকে সর্বোচ্চ মাসিক ১৫০ ডলার দেবে। কিন্তু, অনেকের হাতে আরো বেশী অর্থ আছে।
এখন সেই অর্থ দিয়ে যদি ইনফরমাল মার্কেটে ডলার কেনে সেটা কিনতে হবে, ৮০০ পেসোতে ।
বা যে এইটা এভেলেবল সেইটার রেট অনেক বেশী।
আর ডলার কিনে বাসায় রাখলে, সেইটা চুরি হয়ে যেতে পারে।
ফলে আরজেন্টিনার মানুষ ইট কেনে।
কারন যেহেতু মূল্যস্ফীতি যাহাই হোক, মানুষকে বাসা বানাতে হবে, তাই ইটের দাম কখনো হ্রাস পায় না। ইট সহজে চুরিও হয়না। একই সাথে চাইলেই এইটা সেল করে দেওয়া যায়।
এই কারণে, আরজেন্টিনার মানুষ ইট কেনে।
কিন্তু আমি কেন বলেছি, বাংলাদেশে কিছ লোক ইট কেনা শুরু করেছে?
এইটার কারন বাংলাদেশে একটা আর্থিক সঙ্কট চলছে। এই সংকটের মধ্যেও কিন্তু দেখবেন, ভূমির মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অনেক ধনী লোক রিয়াল এস্টেটে বিনিয়োগ করছে ।
আমার বেশ কিছু বন্ধু জানিয়েছে যে, যে সকল খালি এলাকা অনেক দিন ধরে কেউ হাত দেয়নি, সেই ধরনের কিছু জমিতে এখন ডেভেলপমেন্ট শুরু হয়েছে।
কারন তারা বুঝতে পারছে ব্যাংকে তাদের টাকার মূল্য হ্রাস পেয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা যদি একটা ফ্লাট কেনে বা বাড়ি বানায়, তাহলে তাদের টাকাটার ভ্যালু নষ্ট হবেনা