বাংলাদেশী যদি মানুষ এতো অভাবেই থাকে তবে ১০ হাজার টাকায় কাজের লোক পাওয়া যায় না কেন
আমার একজন বন্ধু প্রশ্নটি করেছেন। আমি মনে করি প্রশ্নটি ভালো। এই আলাপটা সরকার পক্ষের বুদ্ধিজীবীরা প্রায়ই করেন। সমস্যাটা আমার বাসাতেও আমি ফেস করেছি।
এইটা একটা ভালো প্রশ্ন। উত্তরটা কমপ্লেক্স।
আমি নিজেও আমার বাসার অভিজ্ঞতা থেকে এইটা বোঝার চেষ্টা করেছি।
এখানে তিনটা ইস্যু
১। গত সপ্তাহে আমার পরিচিতা একজন নারীকে একটা ইন্টেলেকচুয়াল কাজে, বাংলাদেশের সুপরিচিত একটা প্রতিষ্ঠান সাপ্তাহিক ৬৫ ঘন্টা কাজের জন্যে ৬০০০ টাকা অফার করেছে। আমার সেই পরিচিতা একটা প্রাইভেট ইনিউভারসিটি থেকে মাস্টার্স করা। বেশ মেরিটরিয়াস, পরিশ্রমী । আমি তাকে দিয়ে বেশ কিছু কাজ করিয়েছি।
সে আমাকে জানিয়েছে, ভাইয়া আমি প্রয়োজনে কাজ না করে, ঘরে বসে থাকবো। কিন্তু আমি এই বেতনে এই জব করবো না।
ফার্স্ট হ্যান্ড রেফারেন্স। আপনি আমাকে চ্যালেঞ্জ করলে - চ্যালেঞ্জ নেবো। যদি আপনি গ্যারেন্টি দেন আপনি চট্টগ্রাম শহরে তাকে মিনিমাম ১০ হাজার টাকার একটা চাকুরি দেবেন। আমি এই মুহূর্তে তার মোবাইল নাম্বার দিবো। নেবেন চ্যালেঞ্জ ? নাইলে অফ জান। চ্যালেঞ্জে হেরে গ্যাছেন।
যে প্রতিষ্ঠানটি এই ৬০০০ টাকার জব টার অফার করেছে,তারা জানে এই নারীটির জন্যে চট্টগ্রাম শহরে ৬০০০ টাকা বাদে আর কোন জব নাই। ফলে তারা তাকে মার্কেট রেট ই দিয়েছে। কারন, এই মুহূর্তে তার আর বেটার তেমন কোন অফার নেই।
ঢাকা শহর বাদে বাংলাদেশের প্রায় সকল প্রাইভেট কিন্ডারগারটেনের টিচারদের স্টারটিং স্যালারি ৫ হাজার থেকে ৮ হাজারের মধ্যে।
আমি যত দূর জানি, সিকিউরিটি গারডদের স্টারটিং স্যালারি এখন ১০ হাজার টাকার মত।
আমি অনেক দিন দেশ থেকে দুরে, কিন্তু আমি যত দূর শুনেছি এখনো গ্রাজুয়েটদের স্টারটিং সালারি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। আমি আজকে থেকে ১২ বছর আগে, দেখেছি অনভিজ্ঞ ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের স্টারটিং সালারি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা।
ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, কেন বাজারে আপনি ১২ হাজার টাকাতে দিলে গ্রাজুয়েট পাচ্ছেন কিন্তু, ১০ হাজার টাকায় কাজের মহিলা পাচ্ছেন না ?
আমার মতে, তার পেছেন তিন টা কারন,
১ । এখানে একটি মার্কেট ইস্যু আছে যার কারনে, যে আপনার বাসায় ৮ হাজার টাকায় কাজ করতে প্রস্তুত, সে আপনার কাছে পৌঁছাতে পারতেছে না, আপনি তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। আপনি যে কাউকে বাসায় কাজে নেবেন না। আপনার নিরাপত্তার ইস্যু রয়েছে। ফলে আপনি শুধু মাত্র আপনাকে কাজের বুযা যারা সাপ্লাই দেয় তাদের রেফারেন্সেই কাজের বুয়া নেবেন, এর ফলে, আপনাকে যে কাজের বুয়া সাপ্লাই দেয়, সে একটা ফিল্টার তৈরি করে। এখানে একটা মার্কেট প্রবলেম আছে, মিডল ম্যান প্রবলেম রয়েছে। বাংলাদেশে ১ কোটি মহিলা রয়েছে, যারা আপনার বাসায় ১০ হাজার টাকা দিয়ে কাজ করতে প্রস্তুত। কিন্তু, এই কানেকশানটা মার্কেট তৈরি করে নাই। এবং আপনিও যে কাউকে নেবেন না, সেইটা একটা বড় ইস্যু।
২। দ্বিতীয় কারন, কাজের বুয়ার চাকুরি একটা খুব নির্দিষ্ট এজ, নির্দিষ্ট প্রোফাইল রয়েছে, এই প্রোফাইলটা ম্যাচ না করলে, কেউ কাজের মহিলার চাকুরি নেবেন না। যেমন ১৮ থেকে ৩০ বছরের মহিলারা কাজের বুয়ার কাজ করবেনা। ঠিক তেমনি ৫০ এর উরধ কোন ব্যক্তি কাজের বুয়ার কাজ করবে না। একই সাথে একজন ভালনারেবল গ্রামের মহিলা, সঠিক রেফারেন্স না পেলে কাজের বুয়ার কাজ খুজতে ঢাকা শহরে আসবে না। ফলে, কাজের বুয়ার কাজ করতে প্রস্তত ব্যক্তিরা খুব ছোট্ট একটা গ্রুপ, যাদের পরিবার ছেড়ে আরেকজনের বাসায় গিয়ে কাজ করার মেন্টালিটি পরিবেশ সুযোগ রয়েছে। এবং আমার মতে এই গ্রুপটি খুব ছোট।
আপনি সঠিক কাজের পরিবেশ দেন, সম্মান দেন, নিরাপত্তা দেন, আইডেন্টিটি দেন- আপনি তখন পাবেন অনেককেই পাবেন যারা -আপনার ঘরে এসে কাজ করবে।
বাংলাদেশের গ্রামে এখনো শহরের কাজের বুয়ার কাজকে অসম্মান জনক কাজ হিসেবে দেখা হয়। ফলে চরম দারিদ্র্য যাদের রয়েছে, অথবা ঢাকা শহরের প্রফেশনাল বুয়ারা যারা সিস্টেমটাকে গেম করতে শিখেছে তারা বাদে, ৮ থেকে ১২ হাজার টাকায় কাজ করতে প্রস্তুত লক্ষ লক্ষ মহিলা রয়েছে -তারা কাজের বুয়ার কাজ করবে না।
২। তৃতীয়ত, আপনি ধরে নিচ্ছেন, গ্রাজুয়েটদের স্টারটিং সালারি যেখানে ১০ হাজার কাজের মহিলাকে ১০ হাজার অফার করলে, অনেক বেশী দিতে হচ্ছে। আজকে থেকে ১৫ বছর আগে ৩ হাজার টাকায় কাজের বুয়া পাওয়া যেত আপনার সেই আফসোস এখনো কাটেনি। কিন্তু, আজকে থেকে ১৫ বছর আগের ৩ হাজার টাকার ভ্যালু এখন কত ? সেই সময়ে ৫ হাজার টাকায় ডিসেন্ট লিভিং করা যেত, আপনি এখন যা ২৫ হাজার টাকায় পারবেন না। গাল গল্প না। যাদের বয়স হয়েছে তারা হিসাব করেন।
কিন্তু, ১০ হাজার টাকা কি বাংলাদেশে লিভিং ওয়েজ ?
বাংলাদেশের পরিবার প্রতি গড় সদস্য ৪.২ ফলে। আপনার কাজের বুয়ার যদি স্বামী না থাকে, তিনি যদি একলা কর্মরত হন, তাহলে, তার পরিবারের সকল সদস্যের মাসিক আয় কত, ২.৩ হাজার টাকা। বাংলাদেশের কথিত পার ক্যাপিটা আয় কত ? ২২০০ ডলার আর ১১০ টাকা রেট ধরলে, মাসে ৪৮০০ টাকা।
এই ২.৩ হাজার টাকা দিয়ে কি, একজন কাজের মহিলা তার সংসার চালাতে পারবে ?
এক কেজি চিকেনের দাম কত ? নাকি আপনার চিন্তা হইলো, কাজের বুয়া আবার চিকেনের হিসেব কেন করতে হবে ?
ফলে, আপনি যাকে ১০ হাজার টাকা দিতে চান, সেইটা কেন দিতে চান ? আপনার গ্রাজুয়েট সালারি কম বলে ?
আরএমজিতে ৮ হাজার টাকা পায় বলে ?
আর একটি ক্রিটিকাল ইস্যু হচ্ছে, মার্কেট প্রবলেম যারা সল্ভ করতে পেরেছে, তারা ৪০০০ থেকে ৬০০০ টাকায়, কাজের বুয়া পাচ্ছেন। আমার ফেসবুকে পোস্টে বেশ কয়েক জন জানিয়েছেন, তারা ৪০০ থেকে ৬০০০ টাকা এবং কেউ কেউ আরো কম খরেছে, কাজের বুয়া নিয়োগ দিতে পেরেছেন, এই লেখা প্রকাশের সময় কালেই।
আরো একটা ইস্যু আছে।
৩। গত ডিসেম্বারে বাংলাদেশের এঞ্জিওদের নেটওয়ার্ক স্টার্ট ফান্ড নেটওয়ার্ক , গত ডিসেম্বারে একটি গবেষণায় জানায় গ্রামাঞ্ছলে হত দরিদ্র মানুষের বাৎসরিক আয় ১.১০ লক্ষ এবং দরিদ্রদের আয় ১.৩২ লক্ষ টাকা। ফলে, এই গবেষণা থেকে আমরা পাচ্ছি গ্রামাঞ্ছলে একজন হত দরিদ্রের মাসিক আয় নয় হাজার টাকা এবং সরকারের হিসেবে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪.২ জন । উনি গ্রামে নিজের বাসায় থাকেন। উনি কেন ঢাকা শহরে আপনার বাসায় ১০ হাজার টাকা আসবেন। যদি এই ১০ হাজার টাকা দিয়ে উনাকে ৪.২ জনকে গড়ে সাপোর্ট দিতে হয়, তবে পরিবারের সকল সদস্যের গড় আয় হয় ২.৩ হাজার টাকা।
ফলে আপনি পেটে ভাতে রেখে, যে ১০ হাজার অফার করতেছেন সেইটা একদম হত দরিদ্র মানুষের গড় আয় থেকে ডবল হতে পারে কিন্তু, যদি কারো পরিবারের আরেক জন ব্যক্তি আয় করে তবে, উভয়ের মোট আয় আপনার দেওয়ার ১০ হাজার টকা থেকে বেশী হবে। তবুও ধরে নিচ্ছি, আপনার ১০ অফার করা ১০ হাজার টাকা সালারি, একজন হত দরিদ্র কাজের বুয়ার গড় আয়ের ডবল কিন্তু, এই ডবলটি আয় করার জন্যে এই মহিলাকে =নিজের পরিবারের কম্ফরট, সিকিউরিটি ও বন্ধন ছিন্ন করতে হচ্ছে। এইটা তাদের জন্যে অর্থ ইট না।
ফলে, তারা বেশী সালারি দিলেও আপনার ১০ হাজার টাকার স্লেভারি নিতে হন্য হয়ে আপনার বাসায় ছুঁটে যাবেনা।
বরং আপনি একটা এড দেন শিক্ষিত গ্রাজুয়েট নেবেন, ১৫ হাজার টাকা সালারি, কোন যোগ্যতা দেখা হবেনা। প্রথম আলো আর বিডি জবসে এড দেবেন আপনার অফিস স্টাম্পিড হয়ে যাবে।
প্রবলেম ইজ, আপনি ভাবতেছেন ১০ হাজার টাকায় এই মহিলা আপনার ঘরে কাজ করবে। এখনো আপনার যেইটা রিয়ালাইজেশান আসে নাই, তা হইলো এই ১০ হাজার টাকা থেকে উনার খরছের ৪৮% খাদ্যের পেছনে চলে যায়। আপনি ১০ হাজার টাকা দিয়ে, তেল, জ্বালানী , স্কুলের খরচ সহ, ৪ জনের একটা ফ্যামিলি চালানে, হিসেব করে দেখেন -আধ পেটা থাকতে হয় নাকি , মাছ মাংস সহ খেতে পারে।
ফলে আপনার ১০ হাজার টাকায় কাজের মহিলা রাখার এক্সপেক্টেশানের কারন না দেশ আগায় গ্যাছে, তাই মহিলারা অনেক বেশী দামে কাজ পাচ্ছে তাই তারা ১০ হাজার টাকায় কাজ করতে চায়না বরং ১০ হাজার টাকায় কাজের মহিলা রাখার এক্সপেক্টেশান হইলো, আপনি মনে করেন এই, মহিলা তো ফইন্নি, তার কেন প্রোটিন খাইতে হবে, তার কেন বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হবে , , তাকে আমি ১০ হাজার টাকা দিচ্ছি, পেটে ভাতে রাখতেছি, সেইটা অনেক টাকা। ফলে সে আসবে না কেন ? আপনি ভাবতে পারতেছেন না যে, ১০ হাজার টাকা লিভিং ওয়েজ না।
আরেকটা বিষয় বুজতে হবে, একজন কাজের বুয়া ফ্রেশ গ্রাজুয়েট না। তাদের অধিকাংশই মধ্যবয়সি। । তাদের সংসার চালাতে হয় । তারা ফ্রেশ গ্রাজুয়েটদের মত মেসে থেকে, কোন মতে দিন গুজার করলে তাদের চলে না। তাদের লিভিং ওয়েজ না পেলে তারা শহরে এসে কাজ করবেনা, বরং গ্রামে থাকবে যেখানে তার লিভিং একপেন্স কম।
এখন আমাদের আলোচনা দেখে আরিফ জেবতিক নিশ্চয়ই বলবেন, এই যে আপনি স্বীকার করেছেন গ্রামের মানুষ ও ৯, ১০ হাজার টাকা বেতন পায়। কিন্তু তারা কখন বুঝবেনা, এই ১০ হাজার টাকার ৫০ পারসেন্ট চলে যায় খাবারের পেছনে। ফলে তার কোন ধরনের নিরাপত্তা নাই। তার ফ্যামিলিতে কারো কিডনিতে অসুখ হলে ডায়ালিসিসের সুযোগ নাই।
কিন্তু, আমাদের আলোচনা হইলো, আমরা তো সিঙ্গাপুর আর কানাডা হইছি, আমরা কেন পেটে ভাতে সপ্তাহে এক দিন প্রটিন খাওয়া মানুষের স্বপনকে, আমাদের জাতির অর্জন হিসেবে দেখতেছি।
এই অর্জন তো আমরা আজকে থেকে ১২ বছর আগেই দেখে আসছি। ১৯৭৪ সালের পরেই বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হয়নাই। মানুষের পেটে কম বেশী ভাত ছিল।
আমাদের এক্সপেক্টেশান আমরা কোথায় নামায় আঞ্ছি, সিংগাপুর আর কানাডার স্বপ্ন দেখায়।
গৃহ যুদ্ধ ও সিভিল ওয়ার বাদে বিশ্বের কোথাও এখন মানুষ না খেয়ে মরে না। এমন কি, আফ্রিকার যে সকল দেশে মাটিতে কিছু হয়না, সেই সকলে দেশেও মানুষ না খেয়ে মরে না। ফলে মানুষ খেতে পায় কি পায়না সেইটা কোন উন্নয়নশীল দেশের তুলনার স্তান্দারড নয়। আপনারা সিঙ্গাপুর , আর কানাডা হওয়ার গল্প করেছেন ফলে আমরা সেই স্ট্যান্ডার্ডে তুলনা করছি। ১০ হাজার টাকা দিয়ে আপনি, একটা বাসায় পেটে ভাতে মানুষ রাখার কথা ভাবেন কিভাবে ?
সিঙ্গাপুরে আপনি সেইটা পারবেন ?
পুলিশ এসে জেলে নিয়ে যাবে।
কাজের লোকের মাসিক মজুরী ১০ হাজার না। কমেই পাওয়া যায়। সমস্যা ৫-১০ বা ২০ যাই মাসে আয় করেন না কেন তা দিয়ে বতমানে প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী, নূ্ন্যতম বস্ত্র ও চিকিৎসার ওষুধ এবং সন্তানের পড়াশোনার খরচ মেটানো যায় না।
বাংলাদেশে থেকেও যারা এই মুহুর্তে দারিদ্র্যের বিস্তৃতি বুঝতে পারছেন না অথবা স্বীকার করতে চাচ্ছেন না তাদেরকে আমার আরিফ জেবতিকের মত নির্লজ্জ দলীয় চামচা বলে মনে হয়। একটা দুইটা ঘটনা দিয়ে অনেকেই প্রমাণ করতে চান যে আসলে দারিদ্রের যে চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি সেটা মিথ্যা। দুঃখজনকভাবে আমার ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে যারা এমনটা বলছেন এবং শেয়ার করছেন তাদের প্রায় সকলেই সরকারপন্থী। অন্ধ দলপ্রীতি খুব ক্ষতিকর।
অট ১: ছবিটা পাল্টায়ে আপলোড করবেন বস। মাস্কিংটা ভালো হয় নাই।
অট ২: সাবস্ট্যাকের সেটল হতে হলে যারা ভালো লিখেন, তাদেরকেও লিখতে বলেন প্লিজ। সাবস্ট্যাকে রাইটার-একটিভিস্টদের পুল না থাকলে আমরা পাঠকরাও কিন্তু বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারবো না।